বাংলার মন্দিরের খোঁজে
শ্যামল কুমার ঘোষ
বাংলার মন্দির বলতে এখানে পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরই বোঝানো হয়েছে । মন্দির দর্শনের সুবিধার্থে মন্দির সম্পর্কে কিছু পরিভাষা জেনে রাখা ভাল । প্রত্নতত্ত্ববিদরা বাংলার নিজস্ব মন্দির স্থাপত্যরীতিকে 'বাংলা রীতি' নামে অভিহিত করেছেন । তাঁরা উত্তর উড়িশা থেকে আহৃত 'নাগর' শৈলীর বিবর্তিত রূপ অনুযায়ী 'দেউল' রীতি ছাড়াও বাংলার নিজস্ব রীতিকে 'চালা', 'রত্ন' ও 'দালান' নামের প্রধান তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন ।
চালা মন্দির : বাংলার খড়ো চালের মাটির ঘরের আদলে তৈরী এই শ্রেণীর মন্দির । এই শৈলীর প্রধান বৈশিষ্ট চালার বাঁকানো শীর্ষ ও কার্নিস ।
দোচালা বা এক বাংলা : সামনে পিছনে দুটি ঢালু চাল নামলে বলা হয় দোচালা বা এক বাংলা ।
দোচালা বা একবাংলা। নন্দদুলাল, চন্দননগর ( হুগলি ) |
জোড় বাংলা : ইমারতের অধিকতর স্থায়িত্বের জন্য দুটি দোচালা বা এক বাংলা পাশাপাশি জোড়া থাকলে বলা হয় জোড় বাংলা ।
জোড় বাংলা। উলা বীরনগর ( নদিয়া ) |
চারচালা মন্দির : চারচালা রীতি চারটি চালের সমাহার । দুচালার দুপাশ থেকে আরও দুটি চালা নামলে বলা হয় চারচালা ।
চারচালা। শিব, দিগনগর ( নদিয়া ) |
আটচালা মন্দির : আটচালা মন্দির চারচালারই পরিবর্তিত রূপ । নিচের চারটি চালার উপরে অল্পাধিক উচ্চতার চারটি দেওয়াল তুলে তার উপরে দ্বিতীয় স্তরের আরও চারটি অপেক্ষাকৃত ছোট আয়তনের চালা বিন্যস্ত হলে বলা হয় আটচালা ।
আটচালা। কাঞ্চনপল্লী, কল্যাণী রথতলা ( নদিয়া ) |
এই ভাবে আটচালার উপরে আরও ছোট চারচালা চাপালে হয় বারচালা ।
রত্ন মন্দির : একটি চারচালা ছাদের উপরের মধ্যবর্তী স্থানে একটি 'চূড়া' বা 'রত্ন' বসালে হয় এক রত্ন মন্দির । বিশুদ্ধ রত্ন মন্দিরের বিশেষত্ত্ব হল চালার বাঁকানো কার্নিস ।
অনন্ত বাসুদেব। বাঁশবেড়িয়া ( হুগলি ) |
এক রত্ন মন্দিরের চার কোণে চারটি তুলনায় ছোট রত্ন বসালে হয় পঞ্চ রত্ন মন্দির ।
পঞ্চ রত্ন। শিব, বাগনান চৈতন্যবাটি ( হুগলি ) |
একটি আটচালার নিচের চার কোণে চারটি এবং উপরের চার চালার চার কোণে চারটি রত্ন বসিয়ে তার মাঝ খানে একটি বড় রত্ন বসালে হয় নব রত্ন ।
নবরত্ন। অন্নপূর্ণা, তালপুকুর, ব্যারাকপুর ( উত্তর ২৪ পারগণা |
এমন ভাবে সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩, ১৭, ২১, ২৫ অবধি বাড়ানো যায় । মুর্শিদাবাদ জেলার রত্ন মন্দির গুলিতে কেন্দ্রীয় চূড়াটি হয় অতি বৃহৎ । কিন্তু কোণের রত্ন গুলি অতি ক্ষুদ্র ।
পঁচিশ রত্ন। গোপালজি, কালনা ( বর্ধমান ) |
দালান মন্দির : বাঁকানো কার্নিস বর্জিত, সমতল ছাদের মন্দির হল দালান মন্দির ।
দালান। যুগলকিশোর, আড়ংঘাটা, ( নদিয়া ) |
মিশ্র ধারা : অনেক সময় দেখা যায়, এক শ্রেণীর মন্দিরের উপরে অন্য রীতির মন্দির চাপানো হয়েছে । যেমন দালানের উপর এক রত্ন বা পঞ্চ রত্ন ।
দোলমঞ্চ : সাধারনত চার কোণা । কিন্তু মন্দিরের মতই নানা রীতি । দোল উৎসবের সময় বিগ্রহকে এনে মঞ্চে স্থাপন করলে যাতে সব দিক থেকে দেখা যায় তার জন্য সব দিকই খিলান সহযোগে খোলা থাকে ( ব্যতিক্রম আছে ) ।
দোলমঞ্চ। ঘোষপাড়া, হরিপাল ( হুগলি ) |
রাসমঞ্চ : সাধারনত আটকোণা । নানা রীতি । রাস উৎসবের সময় বিগ্রহ স্থাপনের পরে যাতে সব দিক থেকে যায় তাই সব দিক খোলা থাকে । উনিশ শতকে 'বরোক' পাত্র বা ফুলদানির আকারের চূড়া রাসমঞ্চে জনপ্রিয় হয় ।
রাসমঞ্চ। মিত্র বাড়ি, আঁটপুর ( হুগলি ) |
চাঁদনি : শামিয়ানা বা চাঁদোয়া টাঙানো মণ্ডপ যেমন চারিদিকে খোলা হয় তেমন ভাবে চারি দিকে মুক্ত খিলানসহ দালান ।
এবার মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন প্রতীকের ব্যবহারের কারণ বর্ণনা করা হল :
অলস কন্যা : নানা ভঙ্গিতে কন্যা । প্রসাধনরতা, স্নানান্তে কেশসজ্জারতা, শালভঞ্জিকা, বাতায়নবার্তিনী প্রভৃতি রূপে বাংলার মন্দিরের দেওয়ালে বর্তমান । শক্তির প্রতীক ।
এবার মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন প্রতীকের ব্যবহারের কারণ বর্ণনা করা হল :
অলস কন্যা : নানা ভঙ্গিতে কন্যা । প্রসাধনরতা, স্নানান্তে কেশসজ্জারতা, শালভঞ্জিকা, বাতায়নবার্তিনী প্রভৃতি রূপে বাংলার মন্দিরের দেওয়ালে বর্তমান । শক্তির প্রতীক ।
হংস : অসার বা দোষ পরিহার করে শুধু সার বা গুণটুকু গ্রহণের প্রতীকরূপে মন্দিরগাত্রে থাকে বা থাকতে পারে হংস বা হংসমালা ।
আমলক : আমলকি ফলের মত চারিদিকে শলাকার মত খাঁজকাটা পাথরের বলয় । শীর্ষদেশের এই অঙ্গটি প্রতিকীভাবে মন্দিরশীর্ষের 'বিন্দু' ( 'বিন্দু' শিবাত্মক ) ও গর্ভগৃহের বিগ্রহের মহিমা ও বিভা জগৎ-চরাচরে ছড়িয়ে দেয় ।
অপ্সরা : সমুদ্র মন্থনকালে জল হতে জাত স্বর্গের বারাঙ্গনা । শক্তির প্রতিক ।
নদী-প্রতীক : গর্ভগৃহের দ্বারের দুধারে গঙ্গা-যমুনা বা মকরের মূর্তি, এর অর্থ হল ভক্ত গর্ভগৃহে প্রবেশকালে পবিত্র নদীজলে মানসস্নান করেন । জল জ্ঞানের প্রতীক ।
ফুল-লতা-পাতা : মন্দিরের গায়ে ফুল-লতা-পাতার অলংকরণ পুস্পিত কুঞ্জকাননের প্রতীক । যেখানে কুঞ্জকানন নেই সেখানে দেবতারা থাকেন না ।
লম্ফমান সিংহ ও শার্দুল : শক্তির প্রতীক ।
মৃত্যুলতা : কল্পলতা হল মন্দিরের উপর থেকে নিচে লতার মত কোণাচ। হাতি, সিংহ, লতা-পাতা অরণ্যের প্রতীক। এইভাবে মন্দির হয় অভীষ্ট ফলপ্রদ 'কল্পতরু'। আবার সমস্ত মায়ার মৃত্যু ঘটায় বলে একে 'মৃত্যুলতা'-ও বলা হয়।
অপ্সরা : সমুদ্র মন্থনকালে জল হতে জাত স্বর্গের বারাঙ্গনা । শক্তির প্রতিক ।
নদী-প্রতীক : গর্ভগৃহের দ্বারের দুধারে গঙ্গা-যমুনা বা মকরের মূর্তি, এর অর্থ হল ভক্ত গর্ভগৃহে প্রবেশকালে পবিত্র নদীজলে মানসস্নান করেন । জল জ্ঞানের প্রতীক ।
ফুল-লতা-পাতা : মন্দিরের গায়ে ফুল-লতা-পাতার অলংকরণ পুস্পিত কুঞ্জকাননের প্রতীক । যেখানে কুঞ্জকানন নেই সেখানে দেবতারা থাকেন না ।
লম্ফমান সিংহ ও শার্দুল : শক্তির প্রতীক ।
মৃত্যুলতা : কল্পলতা হল মন্দিরের উপর থেকে নিচে লতার মত কোণাচ। হাতি, সিংহ, লতা-পাতা অরণ্যের প্রতীক। এইভাবে মন্দির হয় অভীষ্ট ফলপ্রদ 'কল্পতরু'। আবার সমস্ত মায়ার মৃত্যু ঘটায় বলে একে 'মৃত্যুলতা'-ও বলা হয়।
( সহায়ক গ্রন্থ : পশ্চিমবঙ্গের মন্দির : শম্ভু ভট্টাচার্য )তথ্য সুত্র: http://templesofbengal.blogspot.in/p/temples-of-bengal.html?m=1
0 Comments
Thank You!!!