খিস্মার রূপকথারা
২রা মে,২০১৮
(যারা সপ্তাহান্তে 'কোথায় যাব, কোথায় যাব' বলে হা পিত্যেশ করেন লেখাটা তাদের জন্য। ঝোলা কাঁধে একদিন বেড়িয়ে পরুন। কথা দিচ্ছি নিরাশ হবেন না।)
Image : (C) Bishnu Das |
কদিন ধরেই একটা মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে। চারপাশের 'আপনজন'দেরকেও ঠিক আপনজন বলে মেনে নিতে পারছি না। অবিশ্বাস, উদাসীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা মনটাকে কেমন বিষিয়ে তুলেছে। এই বিশৃঙ্খলতা থেকে পালিয়ে যেতে মন চাইছে। তাই দুদণ্ড মানসিক শান্তির খোঁজে একদিন একপ্রকার কাউকে না জানিয়েই বেড়িয়ে পরলাম প্রকৃতির মাঝে কিছুটা সময় একাত্ম হতে। প্রকৃতি কখনো আমাকে নিরাশ করেনা। তার সবুজপাতার স্নেহছায়া মায়ের মত আগলে রাখে এবং তার পাখির কুজন প্রকৃত বন্ধুর ন্যায় ভাগ করে নেয় মনের সব দুঃখকষ্ট।
ভোর হতে না হতেই ঊষার আলো গায়ে মেখে বেড়িয়ে পরলাম। সঙ্গী বলতে একটি জলের বোতল আর আমার সাধের ক্যামেরা। উদ্দেশ্য নদীয়া জেলার আড়ংঘাটায় কাছে অবস্থিত খিস্মা অভয়ারণ্য। আড়ংঘাটা রেলস্টেশন থেকে মাত্র ২ কিলোমিটারের পথ। জঙ্গলের গেটের সামনে যখন টোটো এসে দাঁড়ালো ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল পৌনে আটটা। ফরেষ্ট অফিসটাকে ডানপাশে রেখে বাঁপাশের মেঠো পথ ধরে ঢুকে পড়লাম জঙ্গলের গভীরে। গতকালের দিনভর বৃষ্টি এই প্রখর গ্রীষ্মকালীন দাবদাহন খানিকটা প্রশমিত করতে পেরেছে। আবহাওয়া আজ বেশ মনোরম। একটা সোদা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকটায়। কচি শালপাতার ফাঁক দিয়ে সকালের নরম রোদ গালে পড়ে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে সঁপে দেওয়ার বার্তা দিয়ে গেল।
Image : (C) Bishnu Das |
আগে বহুবার এসেছি এই জঙ্গলে। তবে আজকের মত কোনবারই সঙ্গিহীন ছিলাম না। আজ একেবারে একাই এসেছি প্রকৃতিকে নিজের মত করে পাব বলে। সবুজ অরণ্যের রূপ, রস, গন্ধ নিংড়ে নিয়ে তার স্বাদ উপভোগ করতে। ছুটির দিনে এই গ্রীষ্মে পক্ষিপ্রেমীরা বেশ ভীড় জমায়। তবে আজ ছুটির দিন না হওয়ার আমি পুরো একা এই জঙ্গলে বিচরণ করছি। নিজেকে এই বিশাল অরণ্যের অধিপতি বলে মনে হচ্ছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই নাম না জানা একটা উঁচু গাছ থেকে পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম গাছের একেবারে মগডালে এক বিশাল লড়াই চলছে। এ লড়াই বাসস্থানের জন্য লড়াই, এ লড়াই অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। একটা হাড়িচাঁচাকে চারটি ফিমেল প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার সমানে আক্রমণ করে চলেছে। হাড়িচাঁচাও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজের জায়গা সুরক্ষিত করতে। কিন্তু না, পুঁচকে ফ্লাইক্যাচার প্রবল প্রতিরোধ এবং জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হল আকারে ও আয়তনে বড় হাড়িচাঁচা মহাশয়। উপরের দিকে হা করে তাকিয়ে প্রকৃতির এই অপরূপ খেলা প্রান ভরে উপভোগ করলাম।
আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম আমার প্রানের পাখি, দুধরাজকে(মেল প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার)। লম্বা লেজ বিশিষ্ট দুধসাদা, অতিবিরল এই পাখির দেখা পাওয়াটা পক্ষিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মত। তবে এনাকে বশে আনাটা বেশ দুরূহ ব্যাপার। বেটা এতোই ছটফটে যে এনাকে ফ্রেমবন্দি করা আমার মত চুনোপুঁটি ফটোগ্রাফারের সাধ্যি নয়। খানিকক্ষণ দেখা দিয়েই গভীর জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
চোখের স্বাদ কিছুটা মিটলেও মনের স্বাদ পুরোপুরি মেটানো গেল না। দুধরাজের খোঁজে গোটা জঙ্গলটা চষে ফেললাম। কিন্তু না, দুধরাজ অধরাই থেকে গেল। প্রায় ঘন্টা তিনেক এইভাবে জঙ্গলের একাকীত্ব উপভোগ করে ফিরে আসার জন্য মনস্থির করছি হঠাৎ জঙ্গলের গভীর থেকে মিষ্টি কন্ঠের সুরেলা সুর ভেসে আসতে দেখলাম। ঝোপঝাড়ে উঁকিঝুঁকি মেরেও ঠিক ঠাওর করতে পাড়লাম না ডাকটা ঠিক কোথা থেকে আসছে, কারও দেখা পেলাম না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলেছি যদি কারও দেখা পাই। কিন্তু না! আবার বৃথা চেষ্টা। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখলাম ঝোপের মধ্যে থেকে উড়ে এসে আমার সামনেরই একটা ডালে এসে বসেছে বাহারি রঙের এক পুচকে পাখি। নাম তার ইন্ডিয়ান পিট্টা( Indian Pitta)। সুদূর হিমালয় থেকে উড়ে এসে গ্রীষ্ম ঋতুতে অতিবিরল এই পাখিরা আশ্রয় নেয় খিস্মার জঙ্গলে। মাত্র দশ হাত দূরে বসে সুরেলা কন্ঠে ডেকে চলেছে তার সঙ্গীকে আর তার বিরহে কাতর প্রেয়সীর কন্ঠ ভেসে আসছে বহুদূর হতে। এ এক অন্য রকমের অনুভূতি, এক অন্য মাদকতা। নিঙড়ে নিয়ে উপভোগ করলাম প্রকৃতির এই অকৃত্রিম রূপ,রস,গন্ধ। জঙ্গলের মেঠো পথের ধারে ছড়িয়ে থাকা অনুপ্রেরণাগুলি কুড়িয়ে ভরে নিলাম হৃদয়ের অন্তঃস্থলে।
(কিভাবে যাবেন: শিয়ালদা মেল লাইনের গেদে লোকালে আড়ংঘাটা অথবা কৃষ্ণনগর লোকালে বীরনগর নামুন। সেখান থেকে টোটো/অটো করে খিস্মা ফরেস্ট।)
ছবি ও লেখা : Bishnu Das (কপিরাইটেড কনটেন্ট)
সোর্স : ফেসবুক
0 Comments
Thank You!!!