বিষ্ণুপুর কে মন্দিরের শহর বলা হয়ে থাকে। তার কারণ এখানে মল্ল যুগের তৈরী বহু মন্দির অক্ষত কিংবা ধ্বংস প্রায় হয়ে রয়েছে। প্রধান 20-25 টি এবং 100 রও বেশি মন্দির এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের বেশির ভাগ শহরের মাঝখানে, আর বেশ কিছু কৃষ্ণগঞ্জ, শাঁখারীবাজার ও আশে পাশে আছে। এখানে বেশ কিছু বড়ো ঝিল ও রয়েছে যাদের ঐতিহাসিক অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শিল্প এর সূচনা এখান থেকেই হয়েছে। বিষ্ণুপুরে তাঁতশিল্প, টেরাকোটা শিল্প, শঙ্খ শিল্প, লণ্ঠন শিল্প ইত্যাদি বিখ্যাত। টেরাকোটা শিল্পের আদি বাসস্থান বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া।
মল্ল রাজারা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পরে বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন বলে তার নাম অনুসারে মল্ল রাজাদের রাজধানীর নাম হয় বিষ্ণুপুর।
বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে শিবের গাজন মেলা, রথ উৎসব, ঝাঁপ উৎসব ও রাস উৎসব বিখ্যাত। সবচেয়ে উল্লেখ্য হলো বিষ্ণুপুর মেলা।
23 থেকে 27সে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এই মেলা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়।
----------------যাতায়াত ------------------
কলকাতা থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টার পথ বিষ্ণুপুর। ট্রেন বাস কিংবা নিজস্ব গাড়িতেও যাওয়া যায়। ট্রেনে হাওড়া থেকে বা মেদিনীপুর থেকেও যাওয়া যায়। বাস পাইয়া যাবে কলকাতায়, ডানকুনি তে, ডানলপ এ, মেদিনীপুর, তারকেশ্বর এ ইত্যাদি স্থান থেকে।
---------------ঘোরার জায়গা ------------------
বিষ্ণুপুরের মাঝখানে পরে কলেজ রোড। সেখানেই রয়েছে রাসমঞ্চ। রাসমঞ্চ থেকে সোজা গিয়ে বাঁদিকে পড়বে শ্যাম রায় মন্দির, মৃন্ময়ী মন্দিরে, বোরো পাথর দরজা, ছোট পাথর দরজা, রাধা শ্যাম মন্দির, জোর বাংলা, রাধা লাল জিউ মন্দির।
টুরিস্ট লজ থেকে সোজা মিউজিয়াম এর দিকে গেলে মিউজিয়াম থেকে বাঁদিকে পড়বে লাল বাঁধ ও সরবমঙ্গলা মন্দির।
টুরিস্ট লজের বাঁদিকে পরে দলমাদল পাড়া। সেখানে রয়েছে কামান ও ছিন্নমস্তা মন্দির। আরো এগিয়ে গেলে বা দিকে নন্দলাল মন্দির, রাধামাধব মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, ও লালগড় পড়বে।
নিচে সমস্ত মন্দিরের বিবরণ রয়েছে।
হোটেল ও রেস্টুরেন্ট-----------
বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ হোটেল ও লজ কলেজ রোডের উপরেই পড়বে। এছাড়াও রোসিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এর পাশেও কিছু লজ রয়েছে। তবে ঘোড়ার সুবিধার্থে কলেজ রোড দলমাদল পাড়া তেই লজ নেওয়া ভালো। গভর্নমেন্ট টুরিস্ট লজটিও ওখানেই রয়েছে।
বিভিন্ন মন্দির----------
রাসমঞ্চ - মল্ল রাজা বীর হাম্বির আনুমানিক 1600 সালে এই মন্দির টি তৈরী করেন। এর নিচের বেদী মাকরা পাথরের তৈরী আর উপরের স্থাপত্য ইঁটের।
মদন মোহন মন্দির - মন্দির টি তৈরী হয় 1694 সালে মল্ল রাজা দুর্জন সিংহের আমলে। মন্দিরের দেওয়ালে পশু পাখি কৃষ্ণলীলা দশাবতার, ও অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনী ভাস্কর্যে রূপায়িত হয়েছে। এখানে এখনো পূজা হয়।
শ্যাম রায় মন্দির- এটি একই পঞ্চরত্ন মন্দির, মহারাজা রঘুনাথ 1643 সালে এই মন্দির টি প্রতিষ্ঠা করেন।
মৃন্ময়ী মন্দির- মল্ল রাজা জগৎমল্ল 997 সালে এই মন্দির টি তৈরী করেন। দুর্গোৎসবের সময় এখানে পট পূজা করা হয়। এখনো এখানে মায়ের পুজো হয় তোপধ্বনি করে।
জোর বাংলা - দুটি পাশাপাশি দোচালা কুটিরের সমন্বয়ে তৈরী এই মন্দির টি। এই কৃষ্ণরায় মন্দির নামে পরিচিত হলেও বাংলা স্থাপত্য অনুযায়ী একে জোর বাংলা মন্দির বলা হয়।
রাধা শ্যাম মন্দির - রাজা চৈতন্য সিংহ 1758 সালে এই মন্দির তা তৈরি করেন। এই মন্দিরের শিখর টি গম্বুজকৃতির এবং অন্য মন্দির গুলির থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এই মন্দিরে রাধা শ্যাম, নিতাই গৌর, ও জগন্নাথ ঠাকুরের মূর্তি পূজা করা হয়। মন্দিরের পূর্বদিকে তুলসী মঞ্চে ওড়িশার স্থাপত্য লক্ষ্যনীয়।
রাধা লাল জিউ মন্দির - রাজা বীর সিংহ 1658 সালে শ্রী রাধিকা ও কৃষ্ণের আননসের জন্যে এই মন্দির টি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই মন্দিরের বিগ্রহ কৃষ্ণগঞ্জে নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত।
বোরো ও ছোট পাথর দরজা - কথিত আসছে সতেরোশ শতকের শেষ দিকে রাজা বিরসিংহ এই প্রবেশ পথ গুলি নির্মাণ করেন। বড় পাথর দরজা ছিল বিষ্ণুপুরের প্রাচীন দুর্গের উত্তর দিকের প্রবেশ পথ। ছোট দরজা টি এরই কিছু দূরে মুর্চার পাহাড়ের বাঁদিকে অবস্থিত।
পাথরের রথ - ছোট পাথর দরজার উত্তর পূর্ব কোন এই দ্বিতল পাথরের রথ টি নির্মাণ করা হয় সতেরো শতকে। এর নিচের দিকটি রস মঞ্চের ন্যায় এবং উপরের দিকটি অন্যান্য মন্দিরের মতো।
আচার্য যোগেশ চন্দ্র পুরাকৃতি ভবন - এটি বাঁকুড়া জেলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন পুরাবস্তুর বসল সংগ্রহশালা। 1951 সালে মানিকলাল সিংহ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের এই শাখাটি প্রতিষ্ঠা করুন। পরে এর নাম পরিবর্তন করে আচার্য যোগেশ চন্দ্র পুরাকৃতি ভবন রাখা হয়। এখানে পাল ও সেন যুগের, মুঘল আমলের বহু প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি, পুঁথি, পট, কৃষিজাত দ্রব্য ইত্যাদি সংগ্রহ রয়েছে। এটি সকাল 10 তা থেকে সন্ধ্যে 6 তা পর্যন্ত খোলা থাকে। টিকিট 10 টাকা।
লালবাঁধ - বিষ্ণুপুরের সাতটি বিখ্যাত বাঁধের মধ্যে এটি অন্যতম। শ্রী রামকৃষ্ণ দেব মৃন্ময়ী মায়ের দর্শন করে এই এই পুকুরে স্নান করেছিলেন। এরই পাশে রয়েছে সরবমঙ্গলা মন্দির।
------কলেজ রোড --------
দলমাদল কামান - দলমদ্দন থেকে এর নাম হয়ে গেছে দলমাদল কামান। কথিত আছে 1742 সালে নগদে দেবতা এই কামান থেকে গলা বর্ষণ করে ভাস্কর রাও এর নেতৃত্বে আক্রমণকারী বর্গী বাহিনীকে বিতাড়িত করেছিলেন। সেই থেকে এ4 নাম দল(শত্রু) মদ্দন (দমন) কামান। কামান টিকে পরে সরকার কতৃক বেদীর উপরে স্থাপন করা হয়।
ছিন্নমস্তা মন্দির- মেদিনীপুর নিবাসী স্বর্গীয় ক্রীড়শন চন্দ্র গুই 1973 সালে এই মন্দির টি স্থাপন করেন।
জোর মন্দির শ্রেণী - দুটি বড়ো ও একটি ছোট মন্দির নিয়ে অঞ্চলটি জোর মন্দির শ্রেণী নামে পরিচিত। এটি 1726 সালে রাজা গোপাল সিংহ প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়াও অন্যান্য মন্দিরগুলো হলো
নন্দলাল মন্দির - এটি মাকরা পাথরের তৈরী একরত্ন মন্দির। ছিন্নমস্তা মন্দির থেকে এগিয়ে বাঁদিকে অবস্থিত।
রাধামাধব মন্দির - 1737 সালে গোপাল সিংহের পুত্রবধূ চূড়ামণি দেবী মাকরা পাথরের এই মন্দির টি প্রতিষ্ঠা করেন।
কালাচাঁদ মন্দির - 1656 সালে রাজা রঘুনাথ সিংহ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
রাধা গোবিন্দ মন্দির - রাজা গোপাল সিংহের পুত্র কৃষ্ণ সিংহ 1729 সালে ঝামা পাথরের এই মন্দির টি প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়াও অন্যান্য মন্দির গুলি হলো কৃষ্ণ বলরামের মন্দির, মহাপ্রভু মন্দির, লালগড় এ মল্ল এ স্বর মন্দির, মদন গোপাল মন্দির, ইত্যাদি।
বিষ্ণুপুরে কেনা কাটার জন্য আদর্শ হলো টেরাকোটার জিনিস পত্র, ডোকরা শিল্পের তৈরী জিনিসপত্র , বালুচরী সারী, স্বর্ণচরী শাড়ী, ইত্যাদি। এছাড়াও মাটির তৈরী গয়না এখানে দেখতে পাবেন।
0 Comments
Thank You!!!